ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পৃথিবীর কোনো দেশেরই স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধ প্রাণের উৎসর্গ ছাড়া সংঘটিত হয়নি। মুক্তির সোপান রক্তে মসৃণ না হলে স্বাধীনতার মন্দিরে অর্ঘ্য দেওয়া কখনো সম্ভব হয়নি। প্রাণের উৎসর্গ মানেই তো শহিদের রক্ত ঝরা। উৎসর্গ করা প্রাণ শুধু তাদেরই নয়, যারা অস্ত্র হাতে সম্মুখসমরে রণাঙ্গনে শত্রুর মোকাবিলা করে; রক্ত ঝরে যায় সেসব নিরস্ত্র মানুষেরও, যারা স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর সব সংগ্রামে একাত্ম হয়ে থাকেন। এ স্বাপ্নিক মানুষের মধ্যে থাকেন মেধা-মননসমৃদ্ধ কিছু ব্যক্তি, যাদের বলা হয় বুদ্ধিজীবী।
তাদের বুদ্ধি মানে প্রচলিত সামাজিক অর্থে বিষয়লগ্ন বুদ্ধি নয়, তাদের বুদ্ধি বিবেক-নির্দেশিত বুদ্ধি ও মেধা-মনন উৎসারিত সামাজিক দিকনির্দেশনা। স্বাধীনতার শত্রুর কাছে তারা অনায়াসেই বৈরী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যান। কারণ, তারা বিবেকী বুদ্ধি দিয়ে নির্দেশ করেন কোনটি ন্যায় ও অন্যায়; আর তৈরি করে দেন ন্যায়ভিত্তিক এক কাঙ্ক্ষিত সমাজের স্বপ্ন। এ স্বপ্ন আসলে স্বাধীনতার স্বপ্ন। কারণ, স্বাধীনতা মানেই হলো ন্যায়ভিত্তিক শোষণ-বঞ্চনাহীন এক সুষম সমাজ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও স্বাধীনতার স্বপ্ন নির্মাণে এমন বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা স্বীকার্য। স্বাধীন বাংলাদেশে কাঙ্ক্ষিত সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে এমন বুদ্ধিজীবীর মেধা-মনন বাতিঘর হিসাবে কাজ করার কথা ছিল। আসলে এ দুটি কারণেই আমাদের স্বাধীনতার শত্রুদের কাছে শহিদ বুদ্ধিজীবীরা শত্রু হয়ে উঠেছিলেন। কাজেই তাদের বিনাশ ছিল শত্রুদের অন্যতম লক্ষ্য।
২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ সাংকেতিক নামের পাকিস্তানি সামরিক চক্রের হত্যাযজ্ঞের সূচনা থেকেই শুরু হয়েছিল বুদ্ধিজীবী নিধন প্রক্রিয়া। পরবর্তী পর্যায়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত এ নিধনযজ্ঞে সক্রিয় সহযোগী ও দোসর হিসাবে ছিল এদেশীয় কিছু ঘৃণ্য মানুষ, যাদের সামগ্রিক অর্থে রাজাকার হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।
২৫ মার্চ রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অধ্যাপকরা বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের শিকার হন, তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন ড. জি সি দেব, ড. মনিরুজ্জামান এবং ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। জীবদ্দশায় তাদের মেধা-মনন জাতির বিবেক হিসাবেই গণ্য করা হতো।
ন’মাস ধরে স্বাধীনতার সপক্ষের বুদ্ধিজীবীদের তালিকা হয়েছিল এবং সেই তালিকা অনুযায়ী তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। কেউ মুক্তি পেয়েছিলেন, অনেকে পাননি। এ কাজগুলো করেছিল প্রধানত রাজাকাররাই।
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় অনিবার্য ও আসন্ন। সুতরাং, এ পর্যায়ে অনিবার্য বাংলাদেশকে মেধা-মননশূন্য করার লক্ষ্যে বিজয়ের প্রাক্কালে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শুরু এবং শেষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শহিদ বুদ্ধিজীবীর রক্তের অর্ঘে সমৃদ্ধ হয়েছিল। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শহিদ শিক্ষকের মধ্যে ছিলেন ইতিহাস বিভাগের আমার তিন শিক্ষক : সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দীন আহমেদ এবং ড. আবুল খায়ের। এ তিন শহিদ শিক্ষকসহ সব শহিদ বুদ্ধিজীবীর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়েই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয় বলে মনে হয় না। আমরা তো সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে এলাম। আমাদের শ্লাঘাবোধ আছে; কারণ বিগত অর্ধশতকে আমাদের নানাবিধ অর্জনে আমরা বেশ স্ফীত হয়েছি। কিন্তু মনে হয়, অতিবাহিত সময়ে আমাদের করণীয় অনেক কাজ করতে পারিনি। যেমন বিচ্ছিন্ন-এলোমেলো কিছু বর্ণনা-বিবরণ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও পেলাম না। শহিদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা কত? এর উত্তর দেওয়ার মতো তথ্য আমাদের হাতে নেই। গণমাধ্যম অনুযায়ী, এ সংখ্যা হতে পারে ১১১১। প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) ১৩ জন শহিদ সাংবাদিকের তথ্য তুলে ধরেছে তাদের প্রকাশনায় [মো. শাহ আলমগীর (সম্পাদক), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক, ঢাকা, ২০১৫]। কিন্তু চূড়ান্ত তালিকা এখনো দুর্লভ। প্রয়োজন জেলাভিত্তিক তালিকা; যে কাজটি বাংলা একাডেমির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প (১৯৯৭-২০০১) করছিল। কিন্তু মহাপরিচালক হিসাবে আমার মেয়াদ শেষ হওয়ায় প্রকল্পটি অসমাপ্ত রয়ে যায়। অবশ্য সরকারি অনুমোদন ও অর্থায়ন পেতে দু’বছরের বেশি সময় লেগেছিল; আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যার কারণ ছিল। এখন শহিদ বুদ্ধিজীবীর চূড়ান্ত তালিকা দিতে পারে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। আমরা অপেক্ষমাণ থাকব।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : চেয়ার অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)
https://slotbet.online/